রহস্যের অন্তরালে নক্ষত্র.....

১. চন্দ্রের আকাশ পরিক্রমা-পথকে ভারতীয় জ্যোতিঃশাস্ত্রে মোট ২৭টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর এক একটি ভাগকে বলা হয়- চন্দ্রের আবাস বা নক্ষত্র। এই নক্ষত্রগুলো হলো- অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, মৃগশিরা, আর্দ্রা, পুনর্বসু, পুষ্যা, অশ্লেষা, মঘা, পূর্ব-ফাল্গুনী, উত্তর-ফাল্গুনী, হস্তা, চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা, অনুরাধা, জ্যেষ্ঠা, মূলা, পূর্বাষাঢ়া, উত্তরাষাঢ়া, শ্রবণা, ধনিষ্ঠা, শতভিষা, পূর্ব-ভাদ্রপাদ. উত্তর-ভাদ্রপাদ ও রেবতী।  চাঁদের নক্ষত্র-অতিক্রম-কালকে এক চান্দ্রমাস বলা হয়।

২. অভ্যন্তরীণ তাপীয়-নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার দ্বারা শক্তি বিকীরণ করে, এমন উত্তপ্ত গ্যাসীয় মহাকাশীয় বস্তু।

সমার্থক শব্দাবলি : ঋক্ষ, খেট, চন্দ্রধারা, জ্যোতিষ্ক, তারক, তারকা, তারা, নক্ষত্র, ভ, সিতারা।

নক্ষত্রেরর উৎপত্তি ও ক্রমবিবর্তন: মহাকাশে ভাসমান বিপুল পরিমাণ আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তুকণা যখন মহাকর্ষীয় বল দ্বারা আকর্ষিত যখন ঘনীভূত হতে থাকে, তখনই নক্ষত্রের জন্মগ্রহণের সূত্রপাত ঘটে। উল্লেখ্য, এই বস্তুপুঞ্জের প্রায় শতকরা ২২ থেকে ২৮ ভাগ থাকে হিলিয়াম ও সামান্যকিছু ভারী কণা। বাকি ৭০-৭২ ভাগ থেকে হাইড্রোজেন।মহাকাশের কোনো কোনো অংশে এরূপ বস্তুকণা বিশালাকারের মেঘের জন্ম দেয়। এই মেঘের গ্যাসীয় কণাগুলো মহাকর্ষীয় বল দ্বারা পরস্পরের কাছাকাছি আসতে থেকে। কখন কখনো এই বস্তুকণাগুলোকে সঙ্কুচিত করতে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা রাখে, অতিনবতারার বিস্ফোরণ বা গ্যালাক্সিসমূহের আন্তঃসংঘর্ষ।

একটির নক্ষত্রের জন্মের সময় যে তাপ সৃষ্টি করে, নক্ষত্র থেকে তা উত্তাপ এবং আলো হিসাবে নিষ্ক্রমণ হয়। এর ফলে নক্ষত্রের গ্যাসীয় কণাগুলো বাইরের দিকে চলে আসতে চায়, কিন্তু নক্ষত্রের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কণাগুলোকে কেন্দ্রের দিকে টেনে ধরে। এই উভয়মুখী শক্তি যখন একটি সাম্যাবস্থায় আসে, তখন নক্ষত্রগুলো একটি স্থির দশায় চলে আসে।  বিজ্ঞানীদের মতে- এই বস্তুকণাগুলো ক্রমসঙ্কোচনের প্রক্রিয়াটি চলে প্রায় দশ লক্ষ বৎসর ধরে। ব্স্তুপুঞ্জের ক্রমসঙ্কোচনের সূত্রে ‌একটি ঘূর্ণনগতির সৃষ্টি হয়, ফলে সঙ্কুচিত বস্তুকণা গোলকের আকার ধারণ করে। বস্তুপুঞ্জের পারস্পরিক সংঘর্ষে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই তাপমাত্রা যখন প্রায় ১ কোটি কেলভিনে উন্নীত হয়, তখন বস্তপুঞ্জের অভ্যন্তরে নিউক্লীয় বিক্রিয়া শুরু হয়। এই বিক্রিয়ায় হাইড্রোজেন জ্বালানী হিসাবে ব্যবহৃত হয়। বিক্রিয়ার মাধ্যমে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরি হয়। এই বিক্রিয়ায় যে পরিমাণ  হাইড্রোজেন ব্যবহৃত হয়, তার চেয়ে কম পরিমাণ হিলিয়াম তৈরি হয়। বাকি অংশ তাপ ও আলোতে পরিণত হয়।

পক্ষান্তরে সৌরভরের .০৮ গুণ কম ভরের মহাকাশীয় গ্যাসপুঞ্জের কেন্দ্রে তাপমাত্রা ১ কোটি কেলভিনে উন্নীত হতে পারে না। এই কারণে এগুলো নক্ষত্রে পরিণত হয় না। ফলে এরা সঙ্কোচনজনীত তাপ হারিয়ে একসময় শীতল হয়ে যায়। কিন্তু মাধ্যাকর্ষণজনীত কারণে এই জাতীয় গ্যাসপুঞ্জ জমাটবদ্ধ গোলক হয়ে মহাকাশে বিরাজ করে। এদেরকে সাধারণভাবে বলা হয়- বাদামী বামন (brown dwarf)


নক্ষত্র সৃষ্টির প্রথম ধাপ
বস্তুপুঞ্জের সঙ্কোচনে (নক্ষত্রের ভ্রূণদশায়) পারস্পরিক সংঘর্ষে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই তাপমাত্রা যখন প্রায় ১ কোটি কেলভিনে উন্নীত হয়, তখন বস্তপুঞ্জের অভ্যন্তরে নিউক্লীয় বিক্রিয়া শুরু হয়। এই সময় নক্ষত্রের অভ্যন্তরে প্রোটন-প্রোটন চক্র পদ্ধতিতে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম রূপান্তর ঘটে। ২টি হাইড্রোজেন নিউক্লেই 1H (প্রোটন)বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। এর ফলে তৈরি হয় দুটি ডিউটেরিয়াম(deuterium) -এ পরিণত হয়। একই সাথে তৈরি হয় একটি পজিট্রন এবং একটি নিউট্রিনো। নিউট্রিনো মহাকাশে পালিয়ে যায়।


1
1
H
 
1
1
H
 
→ 2
1
D
 
e+ ν
e
 
0.42 MeV


এই পর্যায়ে পজিট্রন এবং ইলেকট্রন পরস্পরের সাথে সংঘর্ষ ঘটে এবং উভয়ই ধ্বংস হয়ে যায়। এই শক্তি দুটি গামা রাশ্ম ফোটন দ্বারা বাহিত হয়

e e+ → γ 1.02 MeV



দ্বিতীয় ধাপ : প্রথম ধাপে উৎপন্ন ১ ডিউটোরিয়াম আরও একটি সাধারণ হাইড্রোজেনের সাথে মিলিত হয়ে তৈরি হয় হিলিয়াম (3He)-তে পরিণত হয়। এটি মূলত হিলিয়ামের একটি আইসোটোপ। এই সময় আরও তৈরি হয় দুটি প্রোটন 
এবং ১টি নিউট্রন এবং একই সাথে গামা রশ্মি নির্গত হয়।

2
1
D
 
1
1
H
 
→ 3
2
He
 
γ 5.49 MeV
তৃতীয় ধাপ: দ্বিতীয় ধাপে উৎপন্ন হিলিয়াম (3He)-এর সাথে একটি হাইড্রোজেন নিউক্লেই 1H (প্রোটোন) যুক্ত হয়ে হিলিয়াম (4He) উৎপন্ন হয়।

সব মিলিয়ে ৪টি হাইড্রোজনে মিলিত হয়ে  হিলিয়াম (4He) তৈরি হওয়া পর্যন্ত যে ফলাফল পাওয়া যায়, তা হলো-
41H → 4He + 2e+ + 2γ + 2νe (26.7 MeV)
প্রকৃত পক্ষে এই পর্যায়ে একটি নক্ষত্রের জন্ম হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এই জাতীয় নক্ষত্রকে প্রধান ধারার নক্ষত্র বলা হয়। উল্লেখ্য আমাদের সূর্য প্রধান ধারার নক্ষত্রের একটি উদাহরণ। প্রধান ধারার নক্ষত্রে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরির প্রক্রিয়ায় যে সকল উপাদান তৈরি হয়, তা পর্যায়ক্রমে নক্ষত্রের অভ্যন্তরে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু নিউট্রিনো কোনো কিছুর সাথে বিক্রিয়া করে না, তাই এই কণা সূর্য থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। মূলত এই নিউট্রিনোর পরিমাণ থেকে এই জাতীয় নক্ষত্রের অভ্যন্তরে ঘটিত বিক্রিয়ার হার সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
নক্ষত্রের ভারি বা হাল্কা বিবেচনা করা হয় সূর্যের ভরের বিচারে। যে সকল নক্ষত্রের ভর সূর্যের ভরের কমপক্ষে ৮ গুণ বেশি তাদেরকে ভারি নক্ষত্র (massive star) বলা হয়। এর কম ভরবিশিষ্ট নক্ষত্রগুলোকে হাল্কা নক্ষত্র বলা যায়।



১. যে সকল নক্ষত্রের ভর সূর্যের ভরের সাধারণত ০.০৭৫ গুণ হয়ে থাকে। এরা লাল বামন তারা (red dwarf star) তারায় পরিণত হয়। এই নক্ষত্রগুলো শেষ পর্যন্ত মৃত্য বরণ করে।



২. যে সকল নক্ষত্রের ভর সৌরভরের ০.৫ থেকে ১০ গুণ বেশি, তাদের কেন্দ্রের হিলিয়াম প্রজ্জ্বলিত হওয়ার পূর্বে এদের বাইরের হাইড্রোজেন স্তর জ্বলে উঠে এবং একটি লাল দানব তারা (red giant star)-য় পরিণত হয়। এই শ্রেণির নক্ষত্রের উল্লেখযোগ্য নমুনা হলো- আর্দ্রা (Betelgeuse)


যে সকল নক্ষত্রের ভর সৌরভরের ০.৫ থেকে ৩০ গুণ বেশি, তাদের কেন্দ্রের হিলিয়াম প্রজ্জ্বলিত হওয়ার পূর্বে এদের বাইরের হাইড্রোজেন স্তর জ্বলে উঠে, সে নক্ষত্রগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে লাল দানব তারা (red giant star) বলা হয়।
লাল দানব তারার অভ্যন্তরভাগ অতি সঙ্কোচনের কারণে, যখন এর আভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা  ১০৮ এবং ঘনত্বের পরিমাণ ১০৮ গ্রাম/বর্গ সেন্টিমিটার হয়, তখন নক্ষত্রের ভিতরে জমে থাকা হিলিয়ামের দহন শুরু হয়। প্রথাবস্থায় হিলিয়াম সংযোজিত হয়ে বেরেলিয়াম-৮ তৈরি করে।
হিলিয়াম দহন শেষে নক্ষত্রটি শ্বেত বামন (white dwarf)  নক্ষত্রে পরিণত হয়।


source: onushilon.org

No comments:

Post a Comment